মাধবী ও ঋষি গালব, একান্তে …
– সুমিত মোদক
গালব : পারলে আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো;
জানি, ক্ষমা করাটা মোটেই সহজ নয়, তবুও …
বছরের পর বছর ধরে
একের পর এক শোষণ করে গেছি;
কেবল, নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য.…
আর তুমি, নীরবে সহ্য করে গেছো,
সঙ্গ দিয়ে গেছো…
তাই, তুমি আমার কাছে দেবী;
শক্তির আধার;
আট শত অশ্ব-শক্তি…
তোমাকে শত কোটি প্রণাম…
মাধবী: একি বলছেন মহর্ষি!
আপনি আপনার ধর্ম পালন করেছেন;
আপনার আর্য ধর্ম,
আপনার পুরুষ ধর্ম…
আর, আমি পালন করেছি আমার ধর্ম;
এক আদর্শ ভারতীয় নারীর ধর্ম…
গালব: আমি অসহায় হয়ে পড়েছিলাম
আমার ধর্মের কাছে,
আমার আদর্শের কাছে,
ন্যায়-নীতির কাছে…
বার বার ভেবেছি,
বার বার দংশন করেছে বিবেক, মনুষ্যত্ব …
তবুও, নিজের স্বার্থ চরিতার্থে তোমাকে করে তুলেছি বলি প্রদত্ত;
আর তুমি, বার বার বলি হয়েছো সভ্যতার যুপকাষ্ঠে;
মাধবী: তবুও তো আপনি আমাকে গ্রহণ করতে পারেননি;
ফিরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন জন্ম ভিটেতে;
সেখানেও ঠাঁই হল না;
সবকিছু ছেড়ে আমি এখন একাকী;
ধ্যানমগ্ন আমার সাধনায়…
অথচ, আপনাকে ভালবেসে বছরের পর বছর মেলে ধরেছি নিজেকে,
এ শরীরটাকে;
সকলে যে, শরীরটাকে ভালবেসেছে;
নিয়েছে ওম…
শরীরের ওম…
সভ্যতার ওম.…
কেবলমাত্র, আপনি পারলেন না;
স্বার্থ শেষে ফিরিয়ে দিলেন আমাকে;
আমার যৌবন, আমার কুমারীত্ব, আমার স্বপ্ন, আমার ভবিষ্যৎ…
সব, সব, সবই ছিল আপনাকে ঘিরে;
সেই আপনিও আমাকে…
গালব: আমি তোমাকে ওভাবে চাইনি কোনোদিন, কোনো সময়ে;
জানো তো, আমার প্রয়োজন ছিল আট শত
ধবধবে সাদা ঘোড়ার .…
সে প্রার্থনা নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার বাবার কাছে,
রাজা যযাতির কাছে;
তিনিই আমাকে দিয়ে ছিলেন আট শত ধবধবে সাদা ঘোড়ার পরিবর্তে তোমাকে;
তোমার মূল্য আটশত ঘোড়ার মূল্যের সমান;
ভারতীয় নারীর মূল্য আট শত ঘোড়ার মূল্যের সমান!
যদিও আমি সে মূল্য পেয়েছিলাম সময়ের কাছ থেকে,
সভ্যতার কাছ থেকে;
মাধবী: আমার বাবা আমাকে আট শত সাদা ঘোড়া মনে করে আপনাকে দিলেন;
আর আপনি দু’ শত ঘোড়ার বিনিময়ে
রাজা হর্ষশ্বরের কাছে রেখে দিলেন এক বছর;
জন্ম নিলো বসুমনা;
তার পর রাজা দিবদাস, উশিনরের কাছে
এক বছর এক বছর করে, দু’ বছর;
জন্ম নিলো প্ৰতর্দন, শিবি;
আপনার কাছে তখন ছয় শত সাদা ঘোড়া;
প্রয়োজন আরও দুই শত…
কিছুতেই আর কিছু হল না;
কোথাও পেলেন না…
গালব: বাধ্য হয়ে যেতে হল গুরুদেব
ঋষি বিশ্বামিত্রের কাছে;
গুরুদেব সেদিন ধমক দিয়ে ছিলেন;
প্রথমেই তোমাকে নিয়ে এলেই আর ঘোড়ার প্রয়োজন হতো না;
তুমি তো একই আট শত সাদা ঘোড়া;
গুরুদেবও দুই শত ঘোড়ার পরিবর্তে এক বছর রেখে দিলেন তোমাকে;
জন্ম দিলে অস্টক;
মাধবী: হ্যাঁ, আমি বার বার জন্ম দিতে পারি আমার পুত্র সন্তানদের;
আমি বার বার কুমারী হতে পারি;
ফিরে পেতে পারি কুমারীত্ব…
কেবল, নারী ধর্ম পালনের জন্য;
হয়ে উঠতে পারি আট শত ধবধবে সাদা ঘোড়া;
যে ঘোড়া টগবগিয়ে ছোটে যুগ যুগ ধরে যুগান্তরে;
এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতায়,
পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়;
গালব: তুমি তো সভ্যতার ধারক, সভ্যতার বাহক;
তুমি তো সম্পদ, এ দেশের কাছে, দশের কাছে;
মাধবী: সে কারণেই তো বার বার বিক্রয় করেছেন আমাকে;
নারীকে…
কখনও ধর্মের নামে;
কখনও দেশের নামে…
কিন্তু আপনি, আপনারা প্রতিবারই ভুলে যান,
আমি এক নারী, ভারতীয় নারী;
আমার বাবাও আমাকে বিলিয়ে দিয়েছেন
সম্মানের আশায়, মহান সাজার আশায়…
তার পর, এক এক করে ভোগ করে গেছে এক এক পুরুষ,
ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে;
প্রয়োজন শেষে তুলেও দিয়েছে আপনার হাতে;
আর আপনি…
গালব: তোমাকে আমি গ্রহণ করতে পারিনি, দেবী;
সেটা আমার অক্ষমতা;
সেটা আমার দুর্বলতা…
তুমি আমাকে ক্ষমা করো;
ক্ষমা কোরো…
মাধবী: ক্ষমা, কাকে ক্ষমা করবো!
এ ভারতবর্ষের উপর!
নাকি, এ সমাজ ব্যবস্থার উপর!
যেখানে নারী শরীরটাকে ভাবে পণ্য;
যৌবনটা অমূল্য সম্পদ;
সে কারণে, কারোর উপর কোনো রাগ নেই,
ক্ষোভ নেই, নেই অভিমান…
তাই, আজও আমি কুমারীত্ব নিয়ে বাঁচি;
বার বার কুমারীত্ব নিয়ে জন্ম নিতে পারি
এ ভারতবর্ষে;
গালব: এখন তা হলে আসি দেবী!
মাধবী: আসতে আপনাকে হবেই পুরুষ;
বাবা বার আপনাকে, আপনাদের আসতেই হবে;
জন্ম নিতে হবে বার বার…
আর ভিতরে ভিতরে আপনারা শেষ হয়ে যাবেন প্রতিবারই;
আপনাদের অপরাধ বোধ আপনাদেরকে নারী জাতীর কাছে নতজানু করবে;
এ নারী শক্তি আপনাদের শক্তি;
এ নারী শক্তির হাতে আপনাদের মুক্তি;
এ নারীর গর্ভে আপনাদের জন্ম;
এ নারীর গর্ভে আপনাদের উত্তর পুরুষ,
আপনাদের ভারতবর্ষ, ভবিষ্যৎ …